সম্প্রতি হাইকোর্টের নির্দেশনা অমান্য করে মাদারীপুরে যৌনপল্লী উচ্ছেদ করা হয়েছে। একটি ইসলামী সংগঠনের ব্যানারে চলা এ উচ্ছেদ অভিযানে অংশ নেন জেলার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। উচ্ছেদ তাণ্ডবে সবর্স্ব হারানো যৌনকর্মীরা প্রশাসনের নীরব ভূমিকাকেই দায়ী করছেন। আর সেই ক্ষতবিক্ষত এলাকাটি ঘুরে বাংলানিউজের বিশেষ প্রতিবেদনের আজ থাকছে- ৩য় ও শেষ পর্ব।
মাদারীপুর থেকে ফিরে: ২৭ আগস্টের পর থেকে যৌনকর্মীরা শুধু যৌনপল্লীতে নয়, হামলায় আহতরা হাসপাতালে চিকিৎসাও নিতে পারছেন না। হামলাকারীরা মাইকিং করেছেন যৌনকর্মীরা যেনো হাসপাতাল থেকে শুরু করে কোথাও আশ্রয় না পায়। এদের জন্য মাদারীপুরের মাটি হারাম।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক যৌনকর্মীর দেখা মিলল মাদারীপুরের পুরান বাজারে। মাথায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে তিনি জীবন-যাপন করছেন। অথচ হাসপাতালে তাদের ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না তাকে। তার মতো ৪০ থেকে ৫০ জন যৌনকর্মী একই দিনে আহত হন। গহনা ছিনিয়ে নেওয়ার সময় অনেকের নাক-কানও ছিঁড়ে যায়।
অনেকে আবার শরীরের নানা অংশে আঘাত পান। কিন্তু স্থানীয় নেতাকর্মীদের ভয়ে কেউ হাসপাতালমুখী হতে পারছেন না। অনেকে জন্ম থেকেই এই যৌনপল্লীতে বেড়ে উঠেছেন। অন্য কোথাও আশ্রয়স্থল পর্যন্ত নেই।
আহত এক যৌনকর্মী বাংলানিউজকে বলেন, ওরা আমাদের হাসপাতালেও ভর্তি হতে দিচ্ছে না। মাদারীপুর সদর হাসপাতালে যাওয়ার পর তারা আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। তিন চারদিন ধরে পেটে একটি দানাও দেইনি। ৫ ভরি স্বর্ণ গেছে, টাকা পয়সা সব গেছে। শরীরের যে একটু চিকিৎসা করাব সেটাও পারছি না।
২৭ তারিখে যেদিন যৌনপল্লীতে হামলা করা হয়, সেদিন মাদারীপুর সদর হাসপাতালে জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত ছিলেন ড. লেলিন।
রোগী ভর্তির বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে ড. লেনিন বাংলানিউজকে বলেন, হামলার শিকার হয়ে ২৭ তারিখে কোনো রোগী এখানে ভর্তি হয়নি। কারণ ঘটনার দিন সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত আমি দায়িত্ব পালন করেছিলাম।
মামলা অজ্ঞাতদের নামে
হামলাকারীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও নির্দিষ্ট কারো নামে মামলা করেনি স্থানীয় প্রশাসন। আসামিরা এখনও যৌনপল্লী এলাকায় অবস্থান নিলেও প্রকৃত দোষীরা এখন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অথচ স্থানীয় প্রশাসন ১৭ জনকে আটক দেখিয়েছে। একই সঙ্গে ২ হাজার ৫শ’ জনের নামে মামলা করেছে পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অপরাধে।
মাদারীপুর বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিলন ভূইয়া দলবল নিয়ে যৌনপল্লী ঘিরে রেখেছেন। এখনও ইসলাহে কওম পরিষদের কর্মী মনির হুজুর ও বাদল হুজুর প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাদের প্রতি প্রশাসনের কোনো নজর নেই।
মাদারীপুর সদর থানার অফিসার ইনচার্জ মনিরুজ্জামান স্বাক্ষরিত এজাহার বা প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে দেখা গেছে, যে ১৭ জনকে ধরা হয়েছে তাদের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে ঘটনার সঙ্গে জড়িত কেউ নেই।
তদন্ত কর্মকর্তাই হামলাকারীদের পক্ষে
জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে যৌনপল্লী হামলার প্রকৃত তথ্য উপাত্ত খুঁজে বের করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মাহমুদা আক্তার কণাকে। কিন্তু প্রকৃত অপরাধী খুঁজে বের করার বদলে তিনি যেন হামলাকারীদের সঙ্গে মিশে গেছেন।
সরকারি তদন্ত কর্মকর্তা হয়ে কেন হামলাকারীদের সাফাই গাইছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ১০জন যেখানে, আমিও সেখানে। মাদারীপুরের প্রাণকেন্দ্রে পল্লীটি থাকুক তা কেউই চায় না। কারণ ১৩ থেকে ১৮ বছরের অনেকে এখানে এসে মাদকাসক্ত হয়ে যাচ্ছে যার অভিযোগ প্রায় আমার কাছে আসতো। এছাড়া এলাকার নারীরা যেসব অভিযোগ নিয়ে আসতো তার সব অভিযোগের সঙ্গে এই যৌনপল্লীটি জড়িত। কারণ তারা দাবি করতেন তাদের স্বামীরা আয় করা টাকা যৌনপল্লীতে খরচা করে আসত।
‘সরকারি তদন্ত বাদ দিয়ে হামলাকারীদের পক্ষ নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি কোনো উত্তর দেননি।’
তদন্ত কর্মকর্তার প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক নূর-উর-রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ঘটনার তদন্তের ভার জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মাহমুদা আক্তার কণাকে দেওয়া হয়েছে। এখন তিনি তদন্ত বাদ দিয়ে হামলাকারীদের সাফাই গাইছেন এমন অভিযোগ এর আগে আমার কাছে কেউ করেনি। তবে তিনি যদি সাফাই গেয়ে থাকেন তবে বিষয়টা আমরা খতিয়ে দেখবো। কারণ তিনি সরকারি কর্মকর্তা হয়ে হামলাকারীদের পক্ষ অবলম্বন করতে পারেন না।